ঢাকা বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

সাটুরিয়ায় বিদ্যালয় নিয়ে দ্বন্দ্ব, শ্রেণীকক্ষে তালা

সাটুরিয়ায় বিদ্যালয় নিয়ে দ্বন্দ্ব, শ্রেণীকক্ষে তালা

মানিকগঞ্জের সাটুরিয়া উপজেলার ছনকা উচ্চ বিদ্যালয় ধলেশ্বরী নদীর পূর্ব পাশ থেকে স্থানান্তর করে পশ্চিম পাশে স্থানান্তরকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্বে দুই দিন ধরে তালা ঝুলছে শ্রেণিকক্ষে। দ্রুত সমাধান না হলে দুই পক্ষের সাথে যে কোনো সময় রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের আশঙ্কা করছেন নদীর দুই পারের বাসিন্দারা। প্রায় দেড় শতাধিক শিক্ষার্থীদের পড়াশুনা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা।

সোমবার (২৮ এপ্রিল) দুপুর ১২টার দিকে ছনকা উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে গিয়ে দেখা যায়, বিদ্যালয়ের দুটি টিনশেড ঘরের প্রত্যেক ক্লাসরুমে ঝুলছে তালা। শিক্ষার্থীরা চট, মাদুর বিছিয়ে বারান্দায় ও খোলা মাঠের নিচে রোদে বসে আছে। আর অভিভাবকরা নানা উৎকণ্ঠায় বসে আছেন বিদ্যালয়ের বাহিরে। এমনকি বিদ্যালয়ের টয়লেটেও ঝুলছে তালা। ফলে অপেক্ষারত শিক্ষার্থী পানি ও টয়লেটের কাজ করছে পাশের বাড়ি থেকে।

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল মজিদ বলেন, আমাদের প্রধান শিক্ষক আব্দুস সালাম ও প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি মোহাম্মদ শাহ্জাহান বিদ্যালয়টি নদী ভাঙনের কথা বলে, নদীর পশ্চিম পাশে নেবার পাঁয়তারা শুরু করেছেন অনেক আগে থেকেই। গত শুক্রবার বিদ্যালয়টি নদীর পশ্চিমে ছনকা বাজারের পাশে অস্থায়ী ঘর তৈরি করে তারা। রবিবার জোড় করে কোন প্রকার রেজুলেশন ছাড়া ছনকা বাজার সংলগ্ন স্থানে ক্লাস শুরু করেন। অপর দিকে আমাদের বর্তমান স্কুলে তালা ঝুলিয়ে দেয়। এতে দুইদিন ধরে ক্লাস বন্ধ রয়েছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ছনকা বর্তমান উচ্চ বিদ্যালয়ে গতকাল হাজিরা খাতা অনুযায়ী ১৩৭ জন উপস্থিত। সবার মধ্যে প্রশ্ন, কবে তাদের বন্ধ শ্রেণিকক্ষ খুলে দেয়া হবে।

বিদ্যালয়ের ৮ম শ্রেণির শিক্ষার্থী ফাহিমা আক্তার বলেন, আমরা স্কুল নিয়ে রাজনীতি চাই না। আমরা ক্লাস করতে চাই। আমরা নদীর পূর্ব পারে বসবাস করে আসছি। আমরা কেন নদী সাতরাইয়ে পশ্চিম পাড়ে যাব।

১০ম শ্রেণির শিক্ষার্থী মিম আক্তার বলেন, আমরা রবিবার ও সোমবার দুই দিন ধরে রোদে কষ্ট করে ক্লাসের অপেক্ষায় বসে আছি। সব ক্লাস রুমেই তালা ঝুলছে কে বা কারা তালা দিয়ে গেছে আমরা তা জানি না,আমাদের দাবি ক্লাস খুলে দেয়া হোক, আমরা দ্রুত ক্লাস করতে চাই।

১০ম শ্রেণির আরেক শিক্ষার্থী মাসুদ বলেন, প্রধান শিক্ষক সালাম স্যার গত বৃহস্পতিবার শেষ ক্লাসের সময় বলেন তোমরা যদি নতুন ভবনে ক্লাস না কর, তাহলে তোমাদের টেস্ট পরীক্ষায় ফেল করিয়ে দেযা হবে।

বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন প্রধান শিক্ষক মো. আব্দুল মজিদ বলেন, উপজেলার বরাইদ ইউনিয়নটি ধলেশ্বরী নদী দ্বারা শাসিত। এখানকার বেশির ভাগ এলাকা চরাঞ্চল। বরাইদ ইউনিয়নের ছনকা গ্রামে আশেপাশে কোনো বিদ্যালয় নেই। সেই আলোকে ২০১৫ সালে সর্বস্তরের জনসাধারণের কথা চিন্তা করে ছনকা গ্রামে ছনকা উচ্চ বিদ্যালয় নামে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করা হয়। এতে চরাঞ্চলের শত শত দরিদ্র শিক্ষার্থীরা সুবিধা পেতে শুরু করে। পরবর্তীতে বিদ্যলয়টি ২০২২ এমপিওভুক্ত করেন তৎকালীন সরকার। কিন্তু বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ শাজাহান এবং প্রধান শিক্ষক আব্দুল সালাম মিলে এলাকার মানুষের সাথে কথা কাটাকাটির একপর্যায় বিদ্যালয়টি ধলেশ্বরী নদীর পূর্ব পাশ থেকে পশ্চিম পাশে নেবার পাঁয়তারা করে। বিদ্যালয়টি বর্তমান স্থানে থাকলে বরাইদ ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ডের মানুষ সহ পাশের ইউনিয়নে অনেকে সুবিধা পাবে। আর পশ্চিম পাশে থাকলে মাত্র ১টি ওয়ার্ডের আংশিক লোক সুবিধা পাবে। কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল, নদীর পশ্চিম পাশে বিদ্যালয় স্থানান্তর করার জন্য জমি ক্রয় করে এবং নতুন একাডেমিক ভবন তৈরি করার জন্য পাঁয়তারা করছে। পরে গত শুক্রবার রাতারাতি কোন রকমে একটি টিনশেড ঘর তৈরি করে রবিবার থেকে আগের ভবনে তালা ও নথিপত্র চুরি করে নতুন স্থানে জোড়াতালি দিয়ে ক্লাস শুরু করার চেষ্টা করছে।

সাটুরিয়া উপজেলা বিএনপির সভাপতি আব্দুল কুদ্দুছ খান মজলিশ মাখন দৈনিক আলোকিত বাংলাদেশ-কে জানান বিদ্যালয়ের স্থান পরিবর্তন করতে চাইলে বিদ্যালয় বিলীন হতে হয়। নীতিমালা ২০২২ (সংশোধিত-২০২৩) এর অনুচ্ছেদ ৫.৮ আলোকে বিদ্যালয় ভবন অক্ষত আছে। বরং নদী থেকে ২৫০ ফিট দূরে। তাছাড়া বিগত ৫ বছরে ওই স্থানে কোনো ভাঙন দেখা দেয়নি বরং চলতি মৌসুমে নদী শাসন চলছে। নদীর তীর ভাঙন রোধে কাজ চলছে। আর বিদ্যালয় স্থানান্তরের আবেদন করা হয় অনেক আগে। তদন্ত করা হয় সেটা গোপনে। আর চিঠি আসে এ বছর ১২ ফেব্রুয়ারিতে। আওয়ামী লীগের দোসররা বরাইদ ইউনিয়নের ৫টি ওয়ার্ডের মানুষের শিক্ষা ব্যবস্থাকে নাজুক করতে স্থানান্তরের পাঁয়তারা করছে। আর এখন স্কুলে তালা দেওয়াতে এ পাড়ের ১৫০ জন শিক্ষার্থীরা দুই দিন ধরে নদীর পশ্চিমপাশে যাচ্ছে না। তারা পুরাতন বিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসেই অবস্থান করছেন।

ছনকা গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, বিদ্যালয়টি যেখানে রাতের আধারে নিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, সেখানে ছনকা বাজার আছে। সেখানে আমাদের মেয়েদের বখাটে দের খপ্পরে পড়তে হবে। তাছাড়া খেয়া পার হতে হবে। খেয়া পার হতে গেলে ৩০ থেকে ৪০ মিনিট বেশি সময় লাগবে। তাই আমরা চাই বিদ্যালয়টি এখানেই থাকুক।

ছনকা গ্রামের রোখসানা বলেন, বিদ্যালয়টি আমাদের জমিতে গড়ে উঠা। আমাদের ঘাম, রক্ত মিশে আছে। তারা বিদ্যালয়টি তালা মারল, আর আরেক স্থানে নিয়ে জোর করে ক্লাস করতে চাচ্ছে। সেটা তো রেজুলেশন করা লাগবে। আমাদের চরাঞ্চল দেখিয়ে বিদ্যালয় অনুমোদন আনল। আর এখন এমপিও ভুক্ত হল। আর অন্য স্থানে নিয়ে যাবে সেটা তো হয় না। আর যে রাজনীতি শুরু হয়েছে। যে কোনো সময় আমাদের পুরাতন ভবনে আগুন লাগাতে পারে। আবার এ নিয়ে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হলে, তার দায় কে নিবে। তাই প্রশাসনের নিকট আকুল আবেদন, আমাদের বিষয়টি সমাধান যাতে করে দেয়।

বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, বিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী ২৬০ জন। ছনকা উচ্চ বিদ্যালয় হলেও এমপিও ভুক্ত হয়েছে নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে। সেই হিসাব অনুযায়ী ১১ জন শিক্ষক ও ৫ জন কর্মচারী আছে। বিদ্যালয় সম্পর্কে বলেন, নিয়ম মেনেই বিদ্যালয়ের স্থানান্তরের কাজ করা হয়েছে।

এ ব্যাপারে সাটুরিয়া উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ফকির জাকির হোসেন বলেন, বিদ্যালয় স্থানান্তরে তাদের নিকট মন্ত্রণালয়ের চিঠি আছে। কিন্তু তারা যেভাবে স্থানান্তর করেছেন, সেটাতো সুন্দয় হয়নি। নদীর দুই পারের অভিভাবকদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে যেতে হবে। কিন্তু প্রধান শিক্ষক সেটা করেননি। এ বিষয়ে সরেজমিনে গিয়ে সাটুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে আমি আজ লিখিতভাবে জানিয়েছি।

এ বিষয়ে সাটুরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. ইকবাল হোসেন বলেন, বিদ্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে সকল শিক্ষক নতুন স্থানে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম শুরু করেছেন। এ বিষয়ে আমি নিজে বিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সাথে গোপনে সাক্ষাৎকার নিয়েছি। বেশির ভাগ শিক্ষার্থীরা চাচ্ছে বর্তমান স্থানে নদীর পূর্ব পাশেই বিদ্যালয় থাকুক। প্রধান শিক্ষককে আমি বলেছি আইন মেনে কাজ করতে। কিন্তু তিনি আইন অমান্য করায় তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিদ্যালয়,দ্বন্দ্ব,শ্রেণীকক্ষ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত